আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিষয়ের বেলজিয়ান শিক্ষক ড. ফিলিপ আনেজ ক্লাসে প্রশ্ন করেছিলেন, "পৃথিবীতে চিরন্তন সত্য কি?" আমরা উত্তর দিলাম –
– "আগামীকাল সূর্য্য উঠবে"
– "পৃথিবী ঘুরবে"
– "নদী সাগরে মিলবে"
তিনি কারও উত্তর গ্রহণ করলেন না । তিনি বললেন – "পৃথিবীতে চিরন্তন সত্য একটাই – মৃত্যু । আমরা সবাই কোন একদিন মারা যাব ।"
পৃথিবী তার কক্ষপথে এক পাক ঘুরে আসার আগেই ড.আনেজ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে চিরন্তন সত্যের প্রমাণ দিয়ে গেলেন ।
চিরন্তন এই সত্যের অর্থ মানুষের বিশ্বাসভেদে ভিন্ন – আমরা বিশ্বাসীরা জানি এর অর্থ প্রত্যাবর্তন – আমার স্রষ্টার নিকট প্রত্যাবর্তন করবো । পৃথিবীতে আগমন এবং প্রত্যাবর্তনের মাঝখানের সময় অতিঅল্প – হোক তা একশ বছর, দ্রুত শেষ হয়ে যায় সেই সময়টুকু । বিদ্যুৎগতিতে যেন শেষ হয়ে গেল গত চল্লিশ বছর ।
এই তো সে দিনের কথা যখন বড় হয়ে আইসক্রিমওয়ালা হতে চাইতাম । স্কুলে যেতাম দুইমাইল হেঁটে । হাইস্কুলে গিয়ে পেলাম সাইকেল – বর্ষাকালে সাইকেল হাঁটিয়ে চার বাঁশের সাঁকো পাড়ি দেয়া ছিল কৌশোরের চ্যালেঞ্জ । সাপ্তাহিক হাটে যেতাম বাড়ির লাউ-সিম নিয়ে । মাথা ন্যাড়া করাতাম পিঁড়িতে বসে – নারায়ণ কাকার দুই হাঁটুর মাঝখানে মাথা রেখে – মাত্র একটাকায় । বাড়ি থেকে মাথায় সাবান মেখে এলে চার আনা কম । দাঁত মাজতাম রান্নাঘরের চুলার কয়লা দিয়ে, অথবা ভাঙ্গতাম নিমগাছের ডাল । বিনোদন? জাল, বড়শি এবং গামছা দিয়ে মাছ ধরা, মাঠে-খালে-বিলে খেলা আর বই পড়া ।
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর বই পড়তে পড়তে মনে হতো বৈজ্ঞানিক হই । বড় হয়ে চাঁদে কিংবা মঙ্গলগ্রহে ঘুরাঘুরি করলে কেমন হয় ! আইসক্রিমওয়ালা থেকে বৈজ্ঞানিক – স্বপ্নের পর স্বপ্ন – সময় উড়ে চলে । যৌবনে পা দেই । মুরুব্বীরা বললেন – "ইঞ্জিনিয়ার হওয়া চাই" । যেন জীবনের সফলতা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ায়, নয়তো ডাক্তার । সেই তত্ব ধারণ করে আল্লাহর ইচ্ছায় ইঞ্জিনিয়ার হলাম । তা একুশ বছর আগের কথা । অতঃপর খুঁজতে লাগলাম জীবনের সফলতা ।
পৃথিবীর পশ্চিমদিক দিয়ে যাত্রা করে পূর্বদিক দিয়ে ফিরে এসেছি । কোথায় সেই সফলতা?
সেকালে এক গামছা দিয়ে তিন ভাই গোসল করতাম – চাপকলে-খালে-পুকুরে। আজ চাই পোর্সেলিনের বাথরুমে ইজিপশিয়ান কটনের টাওয়েল । এটাই কি সফলতা?
হাতে-মাঠে-ঘাটে দৌড়-ঝাঁপ করে রাবারের স্যান্ডেলের ফিতা ছিঁড়ে যেত, আগুন দিয়ে জোড়া লাগাতাম । আবার ছিঁড়তো, আবার লাগাতাম – ব্যবহার করতাম যতদিন না স্যান্ডেলের তলায় ফুটো হয়ে গোঁড়ালি মাটি স্পর্শ করে । এখন দৌড় দিতে চাই একরকম জুতা, ঝাঁপ দিতে আরেকরকম । এটাই কি সফলতা?
সফলতা খুঁজে ফিরেছি নিজ পেশায় । বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষায় ।
অন্য সবাইকেও সফলতা খুঁজতে দেখি চারপাশে – নিজেদের সফলতা, বাচ্চাদের সফলতা । যে মা নিজে না খেয়ে ভাতের থালা নিয়ে বসে থাকতেন, সেই অসুস্থ মাকে দেখতে যাওয়ার সময় হয় না – ছুটি নাই, অথবা ছেলের পরীক্ষা । মৃত্যুশয্যায় বাবার কাছে থেকেছি – তা ছিল সফলতার খোঁজে বের হবার আগে । আজ দেখি বাবা নিঃসঙ্গতায় চলে যান পৃথিবী ছেড়ে যার সব ছেলেমেয়েরাই সফল – আমেরিকা, ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার ইঞ্জিনিয়ার-ডাক্তার-প্রফেসর ।
জীবনের সফলতা কি সত্যিই পেশায়, শিক্ষায় কিংবা জনপ্রিয়তায়? তাহলে সফল সেলিব্রিটিরা আত্মহনন করেন কেন? মাদক আর নেশায় ডুবে থাকেন কেন? বিত্তবানরা, প্রফেশনালরা প্রতিনিয়ত হতাশা আর অস্থিরতায় ভোগেন কেন? এই সফলতার মূল্য কি?
যে জীবন পৌঁছায় চিরন্তন সত্য মৃত্যুতে তার সফলতা আসলে কোথায়?
পৃথিবীতে যদি মৃত্যু হয় চিরন্তন সত্য, তবে সেই সত্যকে গ্রহণের প্রস্তুতিতেই আসল সফলতা । সেই সফলতা অর্জনের পথ একটাই – আল্লাহ এবং তাঁর রসূল (সা:) এর আদেশ এবং নিষেধ মেনে চলার চেষ্টা করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা – যেন মৃত্যুর ফেরেস্তারা এসে বলে "সালাম" । আর বিশ্বাসীরা বলেন – "ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন"। "আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চিত আমরা তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তনকারী" ।
আল্লাহ তাঁর নিকট আমাদের প্রত্যাবর্তনকে সহজ করে দিন, সফল করে দিন । আর যারা ইতিমধ্যে প্রত্যাবর্তন করেছেন, তাদের তিনি ক্ষমা করুন ।। আমীন ।।।
ফারুক আহমেদ,
সাউদার্ন রিভার ।